
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে অনুমোদনহীন চুন ও ঢালাই কারখানায় অবৈধভাবে মাসে প্রায় ৪০ কোটি টাকার গ্যাস ব্যবহার করা হলেও তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি দেখেও না দেখার ভান করছে। এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে কারখানা মালিকদের যোগসাজশ থাকার অভিযোগ স্থানীয়দের। তারা বলছেন, এ আঁতাতের ফলে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতির পাশাপাশি পরিবেশেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি মেঘনাঘাট জোনাল অফিস সূত্র জানায়, প্রতিটি অবৈধ চুন ও ঢালাই কারখানায় মাসে গড়ে ৪৭ লাখ টাকার গ্যাস ব্যবহার হয়ে থাকে। এ হিসেবে এসব কারখানায় মাসে ১০ কোটি টাকার বেশি সরকারি গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে।
জানা যায়, সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলে চুন ও ঢালাই লোহার কারখানায় অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহার ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে ২০২৩ সালে সেগুলো উচ্ছেদ করে স্থানীয় প্রশাসন। এর পর পার্শ্ববর্তী সোনারগাঁ উপজেলায় গড়ে উঠতে শুরু করে এমন কারখানা। বর্তমানে সোনারগাঁয়ে অন্তত ২৩টি অনুমোদনহীন চুন ও ঢালাই কারখানা নির্বিঘ্নে চলছে। সোনারগাঁ পৌরসভা এবং পিরোজপুর, মোগরাপাড়া, কাঁচপুর, সাদিপুর ইউনিয়নে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে এসব কারখানা। অবৈধভাবে গ্যাসের ব্যবহার এবং ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষায় স্থানীয়রা এসব কারখানা দ্রুত উচ্ছেদের দাবি জানিয়েছেন।
পৌরসভা এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চুন কারখানার মালিক জানান, তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য রেখেই তারা এসব কারখানা গড়ে তুলেছেন। প্রতি মাসে তাদের মাসোহারা দিয়ে থাকেন। তিনি জানান, কখনও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হলে সে খবর তারা আগেই পেয়ে যান। তখন গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম তারা সরিয়ে নেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত কারখানা ভেঙে দিলে দু-তিন দিন পর ফের ভাট্টি গড়ে তোলে তাদের মাধ্যমেই ফের সংযোগ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী রাজীব কুমার সাহা বলেন, অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার বিষয়ে তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সভায় উপস্থাপন করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোবারক হোসেন বলেন, পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সোনারগাঁয়ের একাধিক চুনের ভাট্টিতে অভিযান পরিচালনা করে ভেঙে দেওয়ার পর তারা পুনরায় ভাট্টি গড়ে তোলে।
সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ না করায় এ বিষয়ে কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
স্থানীয়রা বলছেন, সোনারগাঁয়ে গত ১৭ বছর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাদক ব্যবসা, অবৈধ কারখানা সহ যেসব অরাজকতা চালিয়েছেন এখন সেগুলো হাত বদল হয়ে স্থানীয় বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে চলছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের আষাঢ়িয়ারচর এলাকায় সোনারগাঁ বিএনপির এক নেতা ও তাঁর ভাই ইউনিয়ন বিএনপির নেতার চুন কারখানা রয়েছে। উপজেলা যুবদলের এক নেতার নেতৃত্বে গঙ্গানগর এলাকায় তাঁর ভাগনে ও আরও কয়েকজন মিলে একটি পরিত্যক্ত গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে চুন কারখানা গড়েছেন এবং পিয়ারনগর গ্রামে দুটি ঢালাই কারখানা করেছেন। ইসলামপুর এলাকায় আরও একটি কারখানা গড়ে তোলার সময় স্থানীয়রা হামলা করে চুনের ভাট্টি ভেঙে দেন। এ ছাড়া প্রতাপেরচরে আরও একটি চুন কারখানা রয়েছে।
একই ইউনিয়নের পিরোজপুর গ্রামে মোজাফফর আলী ফাউন্ডেশনের পাশে ও ইউনিয়ন পরিষদের বিপরীত দিকে সিদ্ধিরগঞ্জের এক বিএনপি নেতা দুটি কারখানা গড়ে তুলেছেন। পিরোজপুর ইউনিয়ন বিএনপির এক নেতা ও তাঁর ভাই তাদের বাড়ির পাশে দুটি ঢালাই কারখানা গড়ে তুলেছেন।
রতনপুর এলাকায় দুটি ঢালাই কারখানা, সোনারগাঁ পৌরসভার ভবনাথপুর গ্রামে রফিকুল ইসলামের পরিত্যক্ত বাড়িতে অবৈধ গ্যাসে ঢালাই কারখানা, দুলালপুর এলাকায় সুরুজ মেম্বারের বাড়ির পাশে গড়ে উঠেছে চুন কারখানা, কাঁচপুর ইউনিয়নের চেঙ্গাইন এলাকায় সাতটি ঢালাই কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে।
সাদিপুর ইউনিয়নে দুটি কারখানা গড়ে উঠেছে। জামপুর ইউনিয়নের মিরেরটেক বাজার এলাকায় একটি এবং মোগরাপাড়া ইউনিয়নে দুটি কারখানা গড়ে উঠেছে। প্রতিটি কারখানা চলে অবৈধভাবে সংযোগ নেওয়া গ্যাস ব্যবহার করে।
এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আব্দুর রউফ অবৈধ চুন কারখানা গড়ে তোলেননি বলে দাবি করেন। সোনারগাঁ উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আশরাফ প্রধান বলেন, চুন কারখানার সঙ্গে তিনি জড়িত নন। এলাকার কিছু কর্মী অবৈধ গ্যাস ব্যবহার করে চুন কারখানা গড়েছেন বলে জানান তিনি।
এক বিএনপি নেতার ভাগনে মামুন মিয়ার দাবি, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এসব কারখানা গড়ে তুলেছেন। তারা পালিয়ে যাওয়ার পর বর্তমানে তারা (বিএনপির নেতাকর্মী) এসব কারখানা চালাচ্ছেন।
আষাঢ়িয়ারচর গ্রামের আবুল হোসেন ও শফিকুল ইসলাম জানান, এ এলাকায় ২০টির বেশি কারখানা গড়ে উঠেছে। ফলে বাসা বাড়িতে গ্যাস পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। রান্নাবান্নায় সমস্যা হচ্ছে। স্থানীয়রা প্রতিবাদ করলেই হামলার শিকার হতে হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চুন কারখানায় পাথর গলানোর কারণে পরিবেশ দূষণ হয়। বাতাসে সিসার পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে আশপাশের মানুষের শ্বাসকষ্ট, শরীরে চর্ম রোগসহ নানা প্রকার রোগ দেখা দেয়। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এলাকার কৃষিতেও। ফল ফলাদির উৎপাদন কমে যাচ্ছে।