
কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার চালিভাঙ্গা ইউনিয়নের রামপ্রসাদের চরে অবৈধ বালুমহল বন্ধ ও ভিটেমাটি রক্ষার আন্দোলন স্থানীয় রাজনীতিতে নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। গত ২০শে জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিতর্ক একদিকে যেমন অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে জনরোষকে সামনে এনেছে, তেমনি অন্যদিকে স্থানীয় বিএনপির দীর্ঘদিনের কোন্দলকেও নতুন করে উসকে দিয়েছে। এই ঘটনা এখন রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
মানববন্ধনে যুবদল নেতাকে ঘিরে বিতর্ক; অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়ার ছবি সম্বলিত ফেস্টুন :
গত ২০শে জুলাইয়ের মানববন্ধনে নলচর গ্রামের যুবদল নেতা রবিউল্লাহ রবির বালুমহলের পক্ষে সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর বিষয় হলো, তার সঙ্গে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক, অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়ার ছবি সংযুক্ত একটি ফেস্টুন প্রদর্শন করা হয়। মানববন্ধনের শুরুতেই এই ফেস্টুন নিয়ে তীব্র বিতর্কের সূত্রপাত হয়। অনেকেই রবিউল্লাহ রবিকে অবৈধ বালুমহলের মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করে তার বহিষ্কারের দাবি জানান। অন্যদিকে, স্থানীয় কতিপয় বিএনপি নেতা, অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়ার ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপচেষ্টার অভিযোগ এনেছেন এবং আন্দোলনকারীদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাদের মতে, রবিউল্লাহ রবির সঙ্গে অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়াকে জড়িয়ে দেখানোর চেষ্টা একটি গভীর চক্রান্তের অংশ।
অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়ার অবস্থান স্পষ্টকরণ: “দ্রুত প্রকৃত বালু সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করুন!”
ঘটনার তীব্রতার মুখে একই দিনে (২০শে জুলাই ২০২৫), বিকাল ৪টার দিকে, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক, অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া তার ফেসবুক পেইজে লাইভে এসে চালিভাঙ্গা ইউনিয়নের রামপ্রসাদের চরের অবৈধ বালুমহল নিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, বালুমহলের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার জন্য প্রশাসনকে বারবার অনুরোধ জানানো হলেও তাদের রহস্যজনক নীরবতা তাকে ক্ষুব্ধ করেছে। তিনি অবৈধ বালুমহল বন্ধের বিষয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে অতীতেও বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করেন। একইসঙ্গে তিনি প্রশাসনের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান, “তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত প্রকৃত বালু সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করুন!”
মানববন্ধনের পরদিনই কমিটি বাতিল: নতুন মোড়কে বিতর্ক!
ঘটনার নাটকীয় মোড় নেয় ২১শে জুলাই, যখন মেঘনা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় চালিভাঙ্গা ইউনিয়ন বিএনপি কমিটি বাতিল ঘোষণা করা হয়। ‘চালিভাঙ্গা ইউনিয়ন নিউজ’ নামের একটি আইডিতে দেখা যায়, যুবদল নেতা রবিউল্লাহ রবিকে বহিষ্কার না করে উল্টো ১৭ বছর ধরে পরিচালিত কমিটি মানববন্ধনের পরের দিনই বাতিল করার ঘোষণায় অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
অনেকে আবার অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়ার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে মন্তব্য করেছেন এই মর্মে যে, “স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন নেতা ভিটেমাটি রক্ষার আন্দোলনে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করায় বালুখেকো রবিউল্লাহ রবির পক্ষাবলম্বন করে তিনি বিএনপির ইউনিয়ন কমিটি ভেঙে দিয়ে অ্যাডভোকেট কামরুজ্জামান ও সাবেক ছাত্রদল নেতা মহসিনকে অপমানিত করার পায়তারা করছেন।” তাদের প্রশ্ন, “তা না হলে কেন ১৭ বছর পর হঠাৎ মানববন্ধনের পরের দিনই কমিটি বাতিলের ঘোষণা জারি করা হলো?”
অ্যাডভোকেট কামরুজ্জামান ও প্রবীণ নেতাদের ক্ষোভ: “গভীর চক্রান্ত চলছে!”
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট কামরুজ্জামানের সঙ্গে ফোনালাপ করা হলে তিনি বলেন, “আমি বালুমহলের বিরুদ্ধে মানববন্ধনে বক্তৃতা দেওয়ায় আমাকে ইউনিয়ন বিএনপির কমিটি থেকে সরানোর লক্ষ্যেই ১৭ বছর পরে আজ হঠাৎ এই ঘোষণা এসেছে।” তিনি আরও বলেন, “বিএনপির দুর্দিনেও আমি হাল ছাড়িনি। অবৈধ বালুমহলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ চালিয়ে গেছি। আজ আমার ভিটেমাটি রক্ষার জন্য মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করায় কমিটি থেকে আমাকে সরানোর গভীর চক্রান্ত চলছে। এই চক্রান্তে স্থানীয় বিএনপির কতিপয় নেতার সূক্ষ্ম ইন্ধন রয়েছে।”
তিনি অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া এবং উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবকে বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানিয়েছেন। ইউনিয়ন বিএনপির প্রবীণ নেতা, বিশিষ্ট কলামিস্ট ও বহুগ্রন্থপ্রণেতা অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন এ বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, “অন্যায়ভাবে কমিটি থেকে কাউকে বহিষ্কার করলে অনেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হবে।”
উপজেলা বিএনপির নীরবতা, যোগাযোগে অনীহা :
মানববন্ধনের পরের দিনই হঠাৎ কমিটি বাতিলের বিষয়ে জানতে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়কের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা যায়নি। সদস্য সচিব পরে কথা বলবেন বলে ফোন রেখে দেন। আর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও চালিভাঙ্গা ইউনিয়নের বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম জহিরকে একাধিকবার ফোন ও মেসেজ করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি, যা তাদের নীরবতাকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে।
জনমনে প্রশ্ন: কী হচ্ছে চালিভাঙ্গা বিএনপিতে?
স্থানীয় ভোটার জনসাধারণের মনে এখন একটাই প্রশ্ন, “আসলে চালিভাঙ্গা ইউনিয়ন বিএনপিতে কী হচ্ছে এসব? চিহ্নিত বালুমহলের মদদদাতারা স্বপদে বহাল, কিন্তু মানবতাবাদী নেতা কামরুজ্জামানের কমিটি বাতিল?” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন সদস্য বিষয়টিতে জনাব তারেক রহমান এবং উচ্চ পর্যায়ের বিএনপি নেতাদের প্রতি সমাধানে দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এই ঘটনা স্পষ্টতই বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে আরও প্রকট করে তুলেছে, যা দলটির সাংগঠনিক স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্নও তুলছে।
অন্যদিকে, বালুমহলের প্রকৃত অপরাধী চক্রকে চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেফতার করা না হলে স্থানীয় বিএনপি নেতারাও এই চক্রের ঘৃণিত অপকর্মের সমালোচনা হতে সহজে মুক্তি পাচ্ছে না বলে দোকানপাটে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে।
মেঘনা উপজেলা যুবদল কমিটি বিতর্ক: আলোচনা তুঙ্গে!
এদিকে, ২২শে জুলাই, মেঘনা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এবং সদস্য সচিব কুমিল্লা যুবদলের কাছে চালিভাঙ্গা যুবদল কমিটি বাতিলের সুপারিশ করেছেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা ও সমালোচনা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।
বিতর্কের মূলে কী?
মেঘনা উপজেলা বিএনপির এই সুপারিশের পর থেকেই প্রশ্ন উঠছে, চালিভাঙ্গা যুবদল কমিটি নিয়ে ঠিক কী কারণে এত অসন্তোষ? কমিটি গঠনে কোনো অনিয়ম হয়েছে, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো রাজনৈতিক সমীকরণ কাজ করছে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে।
ভবিষ্যৎ কী?
এই বিতর্কের শেষ কোথায়, তা নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে। কুমিল্লা যুবদল কি মেঘনা উপজেলা বিএনপির সুপারিশ গ্রহণ করবে, নাকি চালিভাঙ্গা কমিটি বহাল রাখবে -সেটাই এখন দেখার বিষয়। এই সিদ্ধান্ত মেঘনা উপজেলার রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।