২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যখন দলের মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে তৃণমূলের প্রভাবশালী নেতারা আত্মগোপনে কিংবা দেশত্যাগে মরিয়া, তখন পুরান ঢাকার চিত্র কিছুটা ভিন্ন। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বংশাল থানার অন্তর্গত ৩৩ নং ওয়ার্ডে এখনো দাপটের সঙ্গে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ত ৩৩ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল কাদের।
বিগত ১৫ বছর ধরে এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারকারী এই নেতা ৫ আগস্টের পরেও কীভাবে বহাল তবিয়তে রয়েছেন, তা নিয়ে জনমনে উঠেছে হাজারো প্রশ্ন। তবে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য, খোদ বিএনপির কিছু অসাধু নেতার সঙ্গে গোপন আঁতাত ও বিপুল পরিমান অর্থের বিনিময়েই তিনি নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন।
রাজনীতির ভোলবদল: অর্থের বিনিময়ে পুনর্বাসনের চেষ্টা
অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকার পতনের পরপরই আব্দুল কাদের নিজের ভোল পাল্টানোর মিশন শুরু করেন। অভিযোগ রয়েছে, ৩৩ নং ওয়ার্ড বিএনপির কতিপয় প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে তিনি গোপনে বৈঠক করেছেন। স্থানীয় সূত্রের দাবি, নিজের অতীত অপকর্ম ঢাকতে এবং মামলা থেকে বাঁচতে তিনি ওইসব নেতাদের হাতে তুলে দিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৩৩ নং ওয়ার্ড বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের কর্মীরা গত দেড় দশক ধরে জেল-জুলুম খেটেছে, আর আজ আমাদেরই দলের কিছু সুবিধাবাদী নেতা টাকার লোভে সেই নির্যাতনকারী কাদেরকে শেল্টার দিচ্ছে। কাদের এখন নিজেকে ‘বিএনপি ঘরানার’ লোক হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করছে, যা দলের শহীদ কর্মীদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি।”
অতীতের ‘বিভীষিকা’ ও হাজী সেলিমের ছায়া
আব্দুল কাদেরের উত্থান মূলত ঢাকা-৭ আসনের সাবেক বিতর্কিত এমপি হাজী সেলিমের হাত ধরে। হাজী সেলিমের ‘ডান হাত’ হিসেবে পরিচিত কাদের বংশাল এলাকায় গড়ে তুলেছিলেন এক নিজস্ব বাহিনী।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিগত শাসনামলে আব্দুল কাদেরের নির্দেশে পুলিশ বিএনপি ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর চিনিয়ে দিত। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই বহু নেতাকর্মী গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এক ভুক্তভোগী বিএনপি কর্মী বলেন, “কাদেরের লোকজন আমাকে রাস্তায় ফেলে পিটিয়েছিল। পুলিশকে দিয়ে আমার নামে মিথ্যা নাশকতার মামলা দিয়েছিল। আজ সেই কাদেরই নাকি আমাদের নেতাদের বন্ধু!”
৫ আগস্টের রক্তক্ষয়ী অধ্যায় ও কাদেরের ভূমিকা
সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগটি ৫ আগস্টের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত দিনে বংশাল ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে ছাত্র-জনতার ওপর যে সশস্ত্র হামলা চালানো হয়, তাতে আব্দুল কাদেরের প্রত্যক্ষ ইন্ধন ও অংশগ্রহণ ছিল বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সেদিন কাদেরের নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র গ্রুপ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। অথচ সরকার পতনের পর যেখানে হত্যা ও হামলার দায়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা হচ্ছে, সেখানে কাদেরের নাম কোনো এক অদৃশ্য জাদুবলে আড়ালে থেকে যাচ্ছে।
চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য ও অর্থের দাপট
শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রভাবই নয়, আব্দুল কাদেরের শক্তির মূল উৎস তার বিপুল অবৈধ সম্পদ। বংশাল ও এর আশেপাশের এলাকায় ফুটপাত দখল, পরিবহন চাঁদাবাজি এবং দোকানপাট থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মতে, ৫ আগস্টের পর ক্ষমতার পালাবদল হলেও চাঁদাবাজির সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ এখনো পরোক্ষভাবে কাদেরের হাতেই রয়ে গেছে, শুধু ভাগ-বাটোয়ারার অংশীদার পরিবর্তন হয়েছে। এই অবৈধ আয়ের টাকা ছিটিয়েই তিনি প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করে চলছেন।
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের দাবি, আব্দুল কাদেরের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রমাণসহ বংশাল থানায় অভিযোগ জানানো হয়েছে। তার অতীত কর্মকাণ্ড এবং ৫ আগস্টের হামলার ফুটেজ বা সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করছে না। পুলিশের এই নিষ্ক্রিয়তা সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহের দানা বাঁধছে তবে কি থানা পুলিশও ‘ম্যানেজ’ হয়ে গেছে?
তৃণমূল বিএনপির ক্ষোভ ও আল্টিমেটাম
আব্দুল কাদেরের প্রকাশ্যে বিচরণে ৩৩ নং ওয়ার্ড বিএনপির তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। তারা বলছেন, দলের হাইকমান্ড যদি এখনই এই ‘হাইব্রিড’ ও সুবিধাবাদী নেতাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নেয়, তবে দলের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হবে।
স্থানীয় ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক কর্মীদের দাবি, অবিলম্বে আব্দুল কাদেরকে গ্রেপ্তার করে ৫ আগস্টের হামলার বিচার করতে হবে। একইসঙ্গে বিএনপিতে ঘাপটি মেরে থাকা যেসব নেতা তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন, তাদের মুখোশ উন্মোচন করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায়, বংশালের রাজপথ আবারো উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা করছেন সচেতন মহল।