গাজীপুরের রোদে পুড়ে দিনভর বিশেষ সংখ্যার কাজ। বাংলাভূমির সম্পাদকীয় টিমের সঙ্গে মাঠে ছিলেন এক দুরন্ত যোদ্ধা—প্রিয় সাঈদুর রহমান রিমন ভাই। বাংলাদেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অনন্য নাম। তাঁর নেতৃত্বে চলছিলো একটি সাহসী বিশেষ সংখ্যা—বাংলাদেশ বন বিভাগ ও পরিবেশ ধ্বংসের দায় নিয়ে যুগান্তকারী প্রতিবেদন প্রকাশের প্রস্তুতি। আমি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন নিয়ে সম্পাদকের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছিলাম। সঙ্গে বনবিভাগের অন্যান্য আইটেমের দায়িত্বে ছিলেন সাংবাদিক তুহিন ভূঁইয়াসহ অন্যরা। সবাই একযোগে মাঠে ছিলেন। গতকালও ছিলেন। প্রচ্ছদ রিপোর্ট ছিল আমাদের যৌথ নির্মাণ।
রাত জেগে কাজ করার প্রতিজ্ঞা ছিল আমাদের।
যতদিন অন্যায়ের মুখোশ খসে না পড়ে, ততদিন কলম থেমে থাকবে না—এই ছিল শপথ।
আজ (বুধবার) ৩০ জুলাই ২০২৫। লিখছি একান্ত বেদনার সুরে।
গভীর শোক ও কষ্টের সঙ্গে জানাচ্ছি—আমাদের প্রিয় বড়ভাই, বাংলাভূমির প্রধান সম্পাদক, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার দীপ্ত মশাল সাঈদুর রহমান রিমন ভাই আর নেই।
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
আজ (বুধবার) দুপুরে গাজীপুরে হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করেন তিনি। সঙ্গে ছিলাম আমি, সাংবাদিক তুহিন ভূঁইয়া ভাইসহ বাংলাভূমির সহকর্মীরা। প্রথমে গ্যাস্ট্রিক ভেবে ওষুধ দেওয়া হয়। পরে নরওয়ে—বাংলাদেশ হাসপাতালে (রাজেন্দ্রপুর) নেওয়া হলে ইসিজিতে হৃদরোগের সংকেত মেলে। অবস্থা বুঝে দ্রুত তাঁকে তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে বাংলাভূমি সম্পাদক ও প্রকাশক নজরুল ইসলাম আজহার ভাইকে ফোনে জানালে তিনি ভর্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অপেক্ষা করেন। মাঝপথে প্রিয় মিঠুন সিদ্দিকী ভাইয়ের গাড়ি নষ্ট হয়ে পড়লে আরেকটি গাড়িতে তাজউদ্দীন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে…
ডাক্তার জানিয়ে দেন—সব শেষ। দুপুর আনুমানিক আড়াইটায় তাঁর নিঃশ্বাস থেমে যায়। গতকাল (মঙ্গলবার) বিকেলে ও সন্ধ্যারাতেও বাংলাভূমি জয়দেবপুর অফিসে প্রকাশক ও সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজহার ভাইসহ তিনি আমাদের নিয়ে মিটিং করেন। বৃহস্পতিবার রঙিন সংখ্যা হবে। অনেক স্বপ্ন।
আমাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না। একদিন আগেও তিনি লিখেছেন, পরিকল্পনা দিয়েছেন, পত্রিকার প্রতিটি পাতায় তাঁর সৃষ্টিশীল ছাপ রেখেছেন। মৃত্যুর আগেও তিনি “ইয়া হাফিজু, ইয়া হাফিজু” পড়ছিলেন এবং দোআ কালাম পড়ছিলেন। তারপর নরওয়ের কর্তব্যরত ডাক্তার ঔষধ চারটি খাওয়ালে রিমন ভাই বললেন, আমি ভালোবোধ করছি। হাসপাতালে নিতে হবে না। তারপর তাঁর ফের অস্থিরতা দেখা দেয়।
রিমন ভাই ছিলেন—প্রতিভা, মানবিকতা ও নিষ্ঠার প্রতীক।
বাংলাদেশ প্রতিদিন, বিডিনিউজ, দেশবাংলা এবং সর্বশেষ বাংলাভূমি—সবখানে তিনি অনুসন্ধানের আগুন ছড়িয়েছেন। তাঁর হাত ধরেই বাংলাভূমি জাতীয় দৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথে এগোচ্ছিল। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই আমি ‘ভোরের কাগজ’ ছেড়ে ‘বাংলাভূমি’—তে যুক্ত হই। তাঁর পরিকল্পনায়, তাঁর নেতৃত্বে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল।
আজ মনে হচ্ছে, আমরা যেন কণ্ঠহীন হয়ে গেলাম।
সাঈদুর রহমান রিমন ভাই,
আপনি ছিলেন আমাদের দিগন্তজোড়া কলম।
আপনার চোখে ছিল অন্যায়ের অন্ধকার ভেদ করার দীপ্তি।
আপনার হৃদয়ে ছিল অসহায়ের কান্নার প্রতি দায়বদ্ধতা।
আমরা যারা আপনার সতীর্থ, সহযোদ্ধা, কলমসাথী—আমরা আজ ভেঙে পড়েছি। কিন্তু আপনার স্বপ্ন ভেঙে পড়বে না। আপনার অসমাপ্ত প্রতিবেদন, অর্ধলিখিত শিরোনাম, বুকের মধ্যকার যে আগুন আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন, তা আমরা জ্বালিয়ে রাখবো।
আপনাকে জানাই অশ্রুভেজা বিদায়।
আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি—আপনার জীবনের সত্যপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সততার প্রতি দায়বোধের প্রতিদানস্বরূপ, মহান আল্লাহ আপনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান হিসেবে কবুল করুন।
আমীন।
শেষবার আপনি বলেছিলেন, ‘কলম থেমে গেলে অন্যায় জিতে যায়।’
আমরা কলম থামাবো না, ভাই।
আপনার জন্য, দেশের জন্য, সত্যের জন্য লিখে যাবো…
আপনি থাকবেন বাংলাভূমি’র প্রতিটি লাইনে, কর্মে, হাজারও মানুষের হৃদয়ে।