গোপালগঞ্জে জুলুমবাজি নির্দয় নির্মম-সাইদুর রহমান রিমন

গোপালগঞ্জে এনপিসি সমাবেশ ঘিরে সংঘটিত হামলা, পুলিশ ও সেনা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ, ভাঙচুরসহ নানা অরাজকতার ঘটনায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগকে দায়ী করা হলেও গোটা জেলা জনপদই এখন সীমাহীন আক্রোশের মুখে পড়েছে। সেখানকার পাঁচ নাগরিক নিহত/হত্যার পরও প্রতিহিংসার জের শেষ হয়নি, বরং নিপীড়ন-নির্যাতন, হয়রানি, নির্দয়-নির্মমতা চলছে সমানতালেই। বিএনপি, জামায়াতসহ প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতৃবৃন্দ, প্রধান উপদেষ্টা ছাড়াও সকল উপদেষ্টা, পুলিশ প্রধান থেকে শুরু করে অধস্তন পুলিশ কর্মকর্তাদের মুখেও গোপালগঞ্জকে সমুচিত শায়েস্তা করার হুমকি ধমকি শোনা যাচ্ছে অহরহ।

কেউ কেউ গোপালগঞ্জের অস্তিত্ব মুছে ফেলারও ঘোষণা দিয়েছেন বীরদর্পে (!)। ইতোমধ্যেই অপরাধ অপকর্মে অভিযুক্ত পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের শাস্তিমূলক পোস্টিং পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে গোপালগঞ্জে। মোদ্দাকথা, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাতেই গোপালগঞ্জ জেলা ও সেখানকার অধিবাসীদের সাইজ করার কাজ চলছে পরিকল্পিত ভাবে।

রাষ্ট্র যদি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়, যদি আক্রোশী হয়ে ওঠে অভিভাবক- তাহলে সন্তানদের জীবন বাঁচানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সঙ্গতকারণেই গোপালগঞ্জের জনগোষ্ঠীর ভাগ্যে নেমে এসেছে আকাশছোঁয়া দুর্গতি। অত্যাচারী রাজার সীমাহীন নির্মমতায় প্রজারা যেমন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থায় পড়েন, তারচেয়েও নির্দয় নিস্পেষণের মুখে রয়েছেন গোপালগঞ্জের বাসিন্দারা। এমনটাই দাবি করছেন সেখানকার সাধারণ বাসিন্দারা।

শিশুর জন্য দুধ কিনতে বের হওয়া ইলেকট্রিক মিস্ত্রি সাগর শেখ পুলিশের হাতে আ/ট/ক হোন। পাশে তার স্ত্রীর কোলে সন্তান অসহায়ভাবে কাঁদছে, চোখে তার আ/ত/অঙ্ক আর করুণ আকুতি- বাবার মুখেও বেদনার চিৎকার। এমন দৃশ্যপটকে ত্রাহি ত্রাহি ছাড়া আর কোন ভাষায় চিত্রায়িত করা যায় তা জানা নেই আমার।

এনসিপি সমাবেশে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত গোপালগঞ্জের পাঁচ জন অধিবাসী নিহত হয়েছেন। আহতর সংখ্যা দেড়শ‘ ছাড়িয়ে গেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ৩১৫ জনেরও বেশি লোককে। পুলিশের দায়ের করা চারটি মামলায় তিন সহস্রাধিক ব্যক্তিকে আসামি করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী এখন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। পুলিশ, গোয়েন্দা, সেনা বাহিনী, র‌্যাব, বিজিবির অব্যাহত অভিযান, নির্দয় আচরণ, ধরপাকড়ের মুখে হাজার হাজার মানুষ গোপালগঞ্জ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এফবি বন্ধুরা আবার তথ্য উপাত্তের সূত্র ধরে আমাকে গোপালগঞ্জ কানেক্টের কেউ ভাবতে যাবেন না। বৃহত্তর ফরিদপুর, বরিশালের কোথাও কোনো সূত্র নেই আমার, রাজনৈতিক লিংকেজের তো সুযোগই নেই।

যা বলছিলাম, দেশের যে কোনো জনপদ জনগোষ্ঠীর নিজস্ব আবেগ, চাওয়া পাওয়া, ভাষা, কৃষ্টি কালচার, ধর্মীয় অনুভূতি থাকাটা মোটেও অন্যায় নয়, বরং এটাই তার প্রাপ্য অধিকার। সমাজ, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক সব কাঠামো তাদের সেই অধিকার ও আবেগ অনুভূতিকে সম্মান জানাবে- এটাই পৃথিবীর প্রচলিত সভ্যতা। তবে পিছিয়ে থাকা কোনো জনগোষ্ঠী যদি অশিক্ষা, অজ্ঞতায় অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবন ব্যবস্থাতেও রপ্ত থাকে তাহলে সভ্য ও সমাজ সচেতনদের দায়িত্ব হচ্ছে- তাদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া, কুসংস্কার মুক্ত হতে সাহায্য করা। তাই বলে কুসংস্কারে ডুবে থাকা জনপদকে ধ্বংস করে দেওয়া কিংবা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে অতিমাত্রায় ক্ষমতা প্রয়োগের বৈধতা পৃথিবীর কোথাও নেই।

আমরা যদি ধরি যে, গোপালগঞ্জ জেলার বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠী আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিব, শেখ হাসিনায় ডুবে আছে। এটাই তাদের আবেগ, এটাই অনুভূতি- তাহলেও কি তাদেরকে সংস্কারের জন্য জবরদস্তি কিছু চাপাতে পারি? সেই জনগোষ্ঠীর উপর রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাদের আবেগ অনুভূতি নিশ্চিহ্ন করার অধিকার কী কারো আছে? রাষ্ট্রীয় আইন, সামাজিক বিধান, ধর্মীয় নির্দেশনার সকল ক্ষেত্রে তা নিষিদ্ধ। তাহলে?

মহান সৃষ্টিকর্তা এবং তার সর্বশেষ প্রেরিত মহাপুরুষ হজরত মোহাম্মদ (স:) তো নিশ্চিত ভাবেই জানতেন যে, ধর্ম হিসেবে ইসলামই একমাত্র মুক্তি ও নাজাতের পথ। এটাই আল্লাহর বিধান। তারপরও কি তিনি মক্কাবাসীর উপর ইসলাম ধর্ম চাপিয়ে দিয়েছিলেন? ইসলামে অন্তর্ভুক্ত হতে একজন মানুষকেও কি বাধ্য করেছেন? মোটেও না। আমাদের দেশের চাঁদপুরের দিকে একটু নজর দিন। সেখানে প্রতি বছর ৩৯টি গ্রামের মানুষ একদিন আগেই ঈদ উল ফিতর উদ্‌যাপন করে থাকে। অথচ সারাদেশের বাকি প্রায় ৮৫ হাজার গ্রামে ঈদ উদ্‌যাপিত হয় একদিন পরে। এই যে এক দিন আগে ঈদ উদ্‌যাপনের জন্য কী চাঁদপুরের সেই ৩৯টি গ্রামকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে? সেখানকার অধিবাসীদেরও কী ধরে ধরে জেলে ঢুকানো হয়েছে?

হয়নি। কারণ, বিশ্বাস, আবেগ, অনুভূতিসহ নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার ওই বাসিন্দাদের রয়েছে, এটাই বিশ্ব স্বীকৃত স্বাভাবিক বিধান। কিন্তু গোপালগঞ্জ থেকে আওয়ামী আবেগ, সমর্থন, ভালোবাসা মুছে ফেলতে রাষ্ট্র, রাজনীতি, সুশীল সমাজ কেন অতি ক্ষমতা প্রয়োগে মেতে উঠলো? এগুলোই অবিচার, এসবই দু:শাসন- যা আমাদের অত্যাচারী রাজা ও জুলুমবাজ জমিদারদের নির্দয় নির্মমতার কথা বারবারই মনে করিয়ে দেয়। তবে এনসিপির সমাবেশে বাধাদানের ঘটনা শুধু গোপালগঞ্জেই ঘটেনি, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন সাহেবের কক্সবাজারেও ঘটেছে। সেখান থেকেও সেনা ট্যাংকে ভরেই জুলাই বিপ্লবীদের সরিয়ে আনতে হয়েছে। তাই বলে কক্সবাজারকে শায়েস্তা করার ঘোষণা দিতে দেখা যাচ্ছে না কাউকে…কেইসটা কী?

লেখক: প্রধান উপদেষ্টা, বাংলাদেশ সাংবাদিক কমিউনিটি (বিএসসি), প্রধান সম্পাদক – দৈনিক বাংলাভূমি, প্রতিষ্ঠাতা – অনুসন্ধানী সেল, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার দিকপাল, সাইদুর রহমান রিমন।

জাতীয়

সারাদেশ

আন্তর্জাতিক

বিনোদন

খেলা

ডাকদূত – বিজ্ঞাপন – সার্কুলেশন শর্তাবলি ও নীতিমালা – গোপনীয়তা নীতি – যোগাযোগ – নিউজলেটার